The rules, intentions, virtues, deeds and precautions of Shab E Barat prayer Dua of Shabbat Hadith and history about Shab E Barat
শবে বরাতের নামাজের নিয়ম কানুন
প্রকৃত অর্থে শবে বরাতের নামাজ বলে আলাদা কিছু নেই, যেহেতু এই রাতটি ইবাদত বন্দেগী করে কাটাতে হবে তাই হাদিসেই এই সমাধান দেয়া হয়েছে। আর বিশ্ব মুসলিম এই বিশেষ কিছু ইবাদত পালন করে থাকেন। হাদিসের আলোকে আমী সেগুলোর কথাই নিম্নে উল্লেখ করছি:
সন্ধ্যায়:
এই রাতে মাগরিব নামাজের পর হায়াতের বরকত, ঈমানের হেফাযত এবং অন্যের মুখাপেক্ষী না হওয়ার জন্য দু রকাত করে মোট ৬ রকাত নফল নামায পড়া উত্তম।
এই ৬ রাকাত নফল নামাজের নিয়ম:
প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহা এরপর যে কোন একটি সূরা পড়তে হবে। দু রকাত নামায শেষে করে সূরা ইয়াছিন বা সূরা ইফলাছ শরীফ ২১ বার তিলায়াত করতে হবে।
শবে বরাতের নফল নামাজ:
১।দুই রকাত তহিয়াতুল অযুর নামায।
নিয়মঃ প্রতি রকাতে আল হামদুলিল্লাহ ( সূরা ফাতিহা) পড়ার পর , ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং তিন বার ক্বুলহু আল্লাহ শরীফ ( সূরা এখলাছ) ।
ফযীলতঃ প্রতি ফোটা পানির বদলে সাতশত নেকী লিখা হবে।
২। দুই রকাত নফল নামায।
নিয়মঃ ১নং নামাযের মত, প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর, ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং ১৫ বার করে সূরা এখলাছ শরীফ, অতপর সালাম ফিরানোর পর ১২ বার দুরূদ শরীফ।
ফযীলতঃ রুজিতে রবকত, দুঃখ-কষ্ট হতে মুক্তি লাভ করবে, গুনাহ হতে মাগফিরাতের বখসিস পাওয়া যাবে।
৩। ৮ রকাত নফল নামায , দু রকাত করে পড়তে হবে।
নিয়মঃ প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহার পর , সূরা এখলাছ ৫ বার করে। একই নিয়মে বাকি সব।
ফযীলতঃ গুনাহ থেকে পাক হবে , দু’আ কবুল হবে এবং বেশী বেশী নেকী পাওয়া যাবে।
৪। ১২ রকাত নফল নামায , দু রকাত করে।
নিয়মঃ প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহার পর, ১০ বার সূরা এখলাছ এবং এই নিয়মে বাকি নামায শেষ করে , ১০ বার কলমা তওহীদ, ১০ বার কলমা তামজীদ এবং ১০ বার দুরূদ শরীফ।
৫। ১৪ রকাত নফল নামায, দু রকাত করে।
নিয়মঃপ্রতি রকাত সূরা ফাতিহার পর যে কোন একটি সূরা পড়ুন। ফযীলতঃ যে কোন দু’আ চাইলে তা কবুল হবে।
৬। চার রকাত নফল নামায, ১ সালামে পড়তে হবে।
নিয়মঃ প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহা পর ৫০ বার সূরা এখলাছ শরীফ। ফযীলতঃ গুনাহ থেকে এমনভাবে পাক হবে যে সদ্য মায়ের গর্ভ হতে ভুমিষ্ঠ হয়েছে।
৭। ৮ রকাত নফল নামায, ১ সালামে।
নিয়মঃ প্রতি রকাতে সূরা ফাতিহার পর ১১ বার সূরা এখলাছ শরীফ।
শবে বরাতের নামাজের নিয়ত (niyat of shab e barat namaz)
বলা হয়ে থাকে- নিয়তেই বরকত। আপনি যে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়েছেন মনে মনে সেই সিদ্ধান্ত পাকা করলেই আপনার নিয়ত হয়ে যাবে। আরবি, বাংলা যে কোন ভাষাতেই নিয়ত করতে পারেন। বাংলায় নিয়ত করলে এভাবে করতে পারেন: 'শবে বরাতের দুই রাকাত নফল নামাজ/ সালাত কিবলামুখী হয়ে পড়ছি, আল্লাহু আকবর'।
শবে বরাতের নামাজের ফজিলত
এর ফজিলতে সর্ম্পকে বর্ণিত আছে যে, হযরতে সৈয়্যদাতুনা ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহুমা এরশাদ করেছেন, “ আমি ঐ নামাজ আদায় কারীর সাফা’য়াত করা ব্যাতিত জান্নাতে কদম রাখবো না। রোযার ফযীলত হুজুর সালল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে শাবানে ১ দিন রোযা রেখেছে, তাকে আমার সাফা’য়াত হবে। আরো একটি হাদীস শরীফে আছে যে, হুজুর সালল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যাক্তি শাবানের ১৫ তারিখে রোযা রাখবে, তাকে জাহান্নামের আগুন ছোঁবে না। এছাড়াও পড়তে পারেন ‘সালাতুল তাসবীহ এর নামাজ। এই নামাজের অনেক অনেক ফযীলত রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সালল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় চাচা হযরত আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুকে এই নামায শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, এই নামায পড়লে আল্লাহ আয-যাওযাল আপনার আউয়াল আখেরের সগীরা কবীরা জানা অজানা সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।
“হে চাচা জান! আপনি যদি পারেন, তবে দৈনিক একবার করে এই নামায পড়বেন। যদি দৈনিক না পারেন, তবে সপ্তাহে একবার পড়বেন। যদি সপ্তাহে না পারেন, তবে মাসে একবার পড়বেন। যদি মাসে না পারেন, তবে বছরে একবার পড়বেন। যদি এটাও না পারেন, তবে সারা জীবনে একবার হলেও এই নামায পড়বেন ( তবুও ছাড়বেন না)”।
শবে বরাতের নামাজে সতর্কতা (Precaution for Shab Barat prayer)
মনে রাখতে হবে ফরজ নফলের চেয়ে অনেক বড়। শবে বরাতের নামাজ যেহেতু নফল সেহেতু নফল পড়তে পড়তে ফরজ পড়া ভুলে গেলে বা ঘুমের কারণে পড়তে না পারলে কিন্তু সবই শেষ। অর্থাৎ নফল নামাজ পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন আর এই দিকে ফজরের নামাজ পড়তে পারলেন না। সাবধান এ যেন না হয়। ভাল হয় শবে বরাতের নফল শেষ করে বেতের নামাজ পড়ে এর পর ফজর পড়া। যাই করেন নামাজ পড়েন আর ঘুমান সমস্যা নেই, ঠিক সময় মত উঠে ফজর নামাজ যেন পড়তে পারেন সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।
শবে বরাতের গুরুত্ত্বপুর্ন আমল
হযরত আলা ইবনে হারিস ( রহমতুল্লাহি আলাইহি ) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়িশা ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা ) বলেন, একবার রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হয় তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তখন তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা বা ও হুমাইরা! তোমার কি এ আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি বললাম, তা নয়, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা দেখে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যু বরণ করেছেন কিনা। নবীজী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) ভাল জানেন। রাসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বললেন, এটা হল অর্ধ শাবানের রাত। আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানে তাঁর বান্দাদের প্রতি নজর দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। ( বায়হাকী, ৩য় খন্ড-৩৮২পৃ )
এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হল, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া উত্তম, যাতে সিজদাও দীর্ঘ হবে। এছাড়াও এ রাতে কুরআন তেলাওয়াত, যিকির আযকার ইত্যাদি আমল করা যায়।
পরদিন রোযা রাখা যাবে কিনা
হযরত আলী ( রাদীয়াল্লাহু তাআলা আনহু ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বলেছেন,পনেরো শাবানের (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে, তখন তোমরা রাতটি ইবাদত বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনে রোযা রাখ। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছে কি কোন রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দিব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদেরকে ডাকতে থাকেন ( সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস-১৩৮৪,
এই রিওয়াতটির সনদ যইফ। কিন্তু মুহাদ্দিসীনে কেরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যইফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া শাবান মাসে বেশী বেশী নফল রোযা রাখার কথা বহু হাদীসে এসেছে এবং আইয়ামে বীজ তথা প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
শবে বরাতে কবর জিয়ারত
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত কোনো এক রাতে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে না পেয়ে খোঁজ নিতে বের হলাম এবং (জান্নাতুল) বাকিতে গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎ পেলাম। তিনি মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করছিলেন।
তিনি আমাকে বললেন, হে আয়েশা! তোমার মনে কি ভয় হচ্ছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার প্রতি জুলুম করবেন?
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমি মনে করেছিলাম আপনি হয়তো অন্য কোনো বিবির ঘরে তাশরিফ নিয়েছেন।
তখন প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ শাবান মাসের মধ্য রাতে (১৪ শাবান দিবাগত রাতে) দুনিয়ার আসমানে আসেন এবং বনি-কলবের (কলব গোত্রের) বকরিগুলো পশমের চেয়েও বেশি গোনাহগারকে ক্ষমা করে দেন।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)
এ হাদিসটিকেও সনদের ব্যাপারে দুর্বল বলা হয়েছে। অনেকে একে ভ্রান্ত বলেছেন। একান্তই যদি কেউ এ রাতে কবর জিয়ারত করতে চায় তার উচিত একাকি জিয়ারত করা। কেননা প্রিয় নবি একাকি কবর জিয়ারতে গিয়েছেন বলেই হাদিসে উল্লেখ হয়েছে।
আবার অন্য হাদিসে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘জিবরিল আলাইহিস সালাম আমার কাছে এসেছিলেন এবং বললেন, আপনার প্রভু আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন (জান্নাতুল) বাকিতে যাওয়ার জন্য এবং তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য।’ (মুসলিম)
সুতরাং শবে বরাতে রোজা ও কবর জিয়ারতসহ নানা বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি করে ফেতনা ছড়ানো একেবারেই অবান্তর। নিসফা শাবান যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ রাত। সেহেতু এ রাতে আয়োজন ছাড়া একাকি ইবাদত-বন্দেগি, নফল নামাজ, জিকির-আজকার- এর মাধ্যমে অতিবাহিত করাই শ্রেয়। তাই-
==> আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া (নিজ ঘরে) রাত জেগে ইবাদাত করা। তা হতে পারে- নফল নামাজ, জিকির-আজকার, কুরআন তেলাওয়াত ও তাওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি। রোজা ও কবর জিয়ারত ছাড়াও হাদিসে এসেছে-
‘এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন এবং ফজর পর্যন্ত মানুষকে তাঁর কাছে ক্ষমা, রোগ মুক্তি, জাহান্নাম থেকে মুক্তি, রিজিকসহ ইত্যাদি বৈধ প্রয়োজনীয় চাহিদার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে আহ্বান করতে থাকেন।’
==> যারা বর্ণিত হাদিসগুলোকে (জয়ীফ) দুর্বল কিংবা (মওজু) অতি দুর্বল বা ভ্রান্ত মনে করেন, তারা রোজা না রাখলেও যারা নিয়মিত আরবি মাসের আইয়ামে বীজের রোজা পালন করেন তারা যথারীতি রোজা পালন করবেন।
==> আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই একাকি জাঁকজমকবিহীন কবর জিয়ারত করা যেতে পারে। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউকে না জানিয়ে একাকি জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে কবর জিয়ারাত করেছিলেন। এমনকি যা তিনি হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকেও জানাননি।
কবর জিয়ারতের হাদিসটি জয়ীফ কিংবা মওজু যা-ই হোক; যারা যে বিশ্বাস লালন করেন, সেভাবে আমল করেন। কিন্তু কবর জিয়ারত করাই যাবে না কিংবা করতেই হবে এর কোনোটিই ফেতনা ছাড়া ইসলামের জন্য কল্যাণজনক নয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে শবে বরাত নিয়ে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি থেকে হেফাজত করুন। হালুয়া-রুটি, গোসল করা, আলোক সজ্জাসহ সব ধরনের রুসম রেওয়াজ থেকে হেফাজত থাকার তাওফিক দান করুন। পক্ষে-বিপক্ষে সব ধরনের বিতর্ক থেকে হেফাজত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
হযরত আয়েশা সিদ্দীক ( রা:) বর্ণনা করেন
মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে আয়েশা! তুমি কি জান? আজ রাত ( নিসাফে শাবান ) কী? হযরত আয়েশা ( রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা ) বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তো জানি না, দয়া করে বলুন। মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বললেন, আজ রাতে আগামী বছরে যে সমস্ত বনী আদম জমীনের বুকে জন্মগ্রহণ করবে এবং আরা মৃত্যুবরণ করবে, তাদের তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে বান্দাদের আমলনামা মহান আল্লাহর নিকট প্রকাশ করা হয়।
হযরত আয়েশা ( রা:) থেকে বর্ণিত
অপর একটি হাদীসে মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বলেন, আমি এক রাতে মহানবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ঔয়া সাল্লাম )-কে বিছানায় পেলাম না। তাই আমি অত্যন্ত পেরেশান হয়ে খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করলাম। খুঁজতে খুঁজতে দেখি, তিনি জান্নাতুল বাকীর মধ্যে মহান আল্লাহর প্রার্থনায় মগ্ন। তখন তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! আমার নিকট হযরত জিবরাইল ( আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আজ রাত হল নিসফে শাবান ( অর্থাৎ, লাইলাতুল বারাআত )। এ রাতে আল্লাহ তাআলা অধিক পরিমাণে জাহান্নামবাসী লোকদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এমনকি কালব বংশের বকরীগুলোর লোম সমপরিমাণ গুনাহগার বান্দা হলেও। ( মিশকাত শরীফ-১১৫ পৃ )
উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহর তাআলার পক্ষ থেকে মাগফিরাতের দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত করা হয়। কিন্তু শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যাপক রহমত, মাগফিরাত ও সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত থাকে।
হযরত আশরাফ আলী থানভী ( র:)-এর মত
তিনি বলেন হাদীসে শবে বরাতের তিনটি কাজ সুন্নত মত করাকে সওয়াব ও বরকত লাভের উপায় বলা হয়েছে।
প্রথমতঃ পনেরো তারিখ রাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা। সাথে সাথে গরীব মিসকীনদের কিছু দান করে সে দানের সওয়াবটুকু ঐ মৃতদের নামে বখশে দিলে আরও ভাল হয়। সেই মুহূর্তে হাতে না থাকলে, অন্য সময় গোপনে কিছু দান করে দেওয়া উচিত।
দ্বিতীয়তঃ রাত জেগে একা একা বা বিনা আমন্ত্রণে জড়ো হয়ে যাওয়া দু চারজনের সাথে ইবাদতে মশগুল থাকা।
তৃতীয়তঃ শাবানের পনেরো তারিখ নফল রোযা রাখা।
শবে বরাত বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস পর্ব-১
‘মধ্য শাবানের রজনী’ বা ‘শবে বারাত’ বিষয়ক সকল সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস সনদ-সহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে শবে বরাত: ফযীলত ও আমল’’ নামক গ্রন্থে। এখানে আমি এ বিষয়ক জাল হাদীসগুলো আলোচনা করতে চাই। প্রসঙ্গত এ বিষয়ক সহীহ ও যয়ীফ হাদীসগুলোর বিষয়েও কিছু কথা আসবে।
১. মধ্য শাবানের রাত্রির বিশেষ মাগফিরাত
এ বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে:
إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ
‘‘মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’’
এ অর্থের হাদীস কাছাকাছি শব্দে ৮ জন সাহাবী:
১) আবূ মূসা আশআরী,
২) আউফ ইবনু মালিক,
৩) আব্দুল্লাহ ইবনু আমর,
৪) মুয়ায ইবনু জাবাল,
৫) আবু সা’লাবা আল-খুশানী,
৬) আবূ হুরাইরা,
৭) আয়েশা ও
৮) আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে।
( ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৫; বাযযার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবনু আবি আসিম, আস-সুন্নাহ,পৃ ২২৩-২২৪; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবারানী, আল-মুজাম আল-কাবীর, ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মুজাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাক্বী, শু’আবুল ঈমান, ৩/৩৮১; ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬।) এ সকল হাদীসের সনদ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা উপর্যুক্ত গ্রন্থে করেছি। এগুলোর মধ্যে কিছু সনদ দুর্বল ও কিছু সনদ ‘হাসান’ পর্যায়ের। সামগ্রিক বিচারে হাদীসটি সহীহ। শাইখ আলবানী বলেন, ‘‘হাদীসটি সহীহ। তা অনেক সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।...(আলবানী, সাহীহাহ (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ) ৩/১৩৫।)
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রিটি একটি বরকতময় রাত এবং এ রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন। কিন্তু এ ক্ষমা অর্জনের জন্য শিরক ও বিদ্বেষ বর্জন ব্যতীত অন্য কোনো আমল করার প্রয়োজন আছে কি না তা এই হাদীসে উল্লেখ নেই।
শবে বরাত বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস পর্ব-২
২. মধ্য শাবানের রাত্রিতে ভাগ্য লিখন
কিছু কিছু হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ রাত্রিতে ভাগ্য অনুলিপি করা হয় বা পরবর্তী বছরের জন্য হায়াত-মউত ও রিযক ইত্যাদির অনুলিপি করা হয়। হাদীসগুলোর সনদ বিস্তারিত আলোচনা করেছি উপর্যুক্ত পুস্তকটিতে। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো অত্যন্ত দুর্বল অথবা বানোয়াট। এ অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয় নি।
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেন:
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
‘‘আমি তো তা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’’( সূরা (৪৪) দুখান: আয়াত ৩-৪।)
এ বাণীর ব্যাখ্যায় তাবিয়ী ইকরিমাহ, বলেন, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘মধ্য শা’বানের রাতকে’ বুঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ বলেন, এ রাতে গোটা বছরের সকল বিষয়ে ফয়সালা করা হয়।( তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯।)
মুফাস্সিরগণ ইকরিমার এ মত গ্রহণ করেন নি। ইমাম তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরিমার এ ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পরে তার প্রতিবাদ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ইকরিমার এ মত ভিত্তিহীন। তিনি বলেন যে, সঠিক মত হলো, এখানে ‘মুবারক রজনী’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বাদ্র’-কে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ যে রাত্রিতে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন সে রাত্রিকে এক স্থানে লাইলাতুল কাদ্র: ‘তাকদীরের রাত’ বা ‘মর্যাদার রাত’ বলে অভিহিত করেছেন( সূরা (৯৭) কাদ্র: আয়াত ১।) অন্যত্র এ রাত্রিকেই ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা ‘বরকতময় রজনী’ বলে অভিহিত করেছেন। এবং এ রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামাদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, তিনি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন।( সূরা (২) বাকারা: আয়াত ১৮৫।)এথেকে প্রমাণিত হয় যে, মুবারক রজনী রামাদান মাসে, শাবান মাসে নয়।( তাবারী, তাফসীর ২৫/১০৭-১০৯।)
পরবর্তী মুফাস্সিরগণ ইমাম তাবারীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, ‘মুবারক রজনী’ বলতে এখানে ‘মহিমান্বিত রজনী’ বা ‘লাইলাতুল ক্বাদ্র’ বুঝানো হয়েছে। তাঁদের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ এবং ‘লাইলাতুল কাদ্র’ একই রাতের দুটি উপাধি। দুটি কারণে মুফাস্সিরগণ ইকরিমার তাফসীরকে বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন:
(ক) ইকরিমার মতটি কুরআনের সুস্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। কুরআনে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। অন্যত্র বলেছেন যে, একটি মুবারক রাত্রিতে ও একটি মহিমান্বিত রাত্রিতে তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। এ সকল আয়াতের সমন্বিত সুস্পষ্ট অর্থ হলো, আল্লাহ রামাদান মাসের এক রাত্রিতে কুরআন নাযিল করেছেন এবং সে রাতটি বরকতময় ও মহিমান্বিত। মুবারক রজনীকে শবে বরাত বলে দাবী করলে এ আয়াতগুলোর স্পষ্ট অর্থ বিভিন্ন অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বাতিল করতে হয়।
(খ) বিভিন্ন সাহাবী ও তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা ‘মুবারক রজনী’-র ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ রাতটি হলো ‘লাইলাতুল কাদ্র’ বা ‘মহিমান্বিত রজনী’। সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবনু আববাস (রা) ও ইবনু উমার (রা) থেকে অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাবিয়ীগণের মধ্যে থেকে আবু আব্দুর রহমান আল-সুলামী (৭৪ হি), মুজাহিদ বিন জাব্র (১০২ হি), হাসান বসরী (১১০ হি), ক্বাতাদা ইবনু দি‘আমা (১১৭ হি) ও আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম মাদানী (১৮২ হি) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সকলেই বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ অর্থ লাইলাতুল কাদ্র।( নাহহাস, মা’আনিল কুরআন ৬/৩৯৫; যামাখশারী, আল-কাশশাফ ৩/৪২৯; ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন ৪/১৬৯০; ইবনু আতিয়্যাহ্, আল- মুহাররার আল ওয়াজীয ৫/৬৮-৬৯; কুরতুবী, তাফসীর ১৬/১২৬; আবু হাইয়্যান, আল-বাহর আল-মুহীত ৮/৩২-৩৩; ইবনু কাছীর, তাফসীর ৪/১৪০; সুয়ূতী, আদদুররুল মানসূর ৫/৭৩৮-৭৪২; আবুস সু’উদ, তাফসীর-ই-আবিস সু’উদ ৮/৫৮; শাওকানী, ফাতহুল ক্বাদীর ৪/৫৭০-৫৭২; আলুসী, রূহুল মা’আনী ১৩/১১০; থানবী, তাফসীর-ই আশরাফী ৫/৬১৫-৬১৬; শানক্বীতী, মুহাম্মদ আমীন, আদওয়া আল- বায়ান ৭/৩১৯; সাবুনী, মুহাম্মদ আলী, সাফওয়াতুত তাফাসীর ৩/১৭০-১৭১; মুফতী শফী, মা’আরেফ আল-কুরআন ৭/৮৩৫-৮৩৬।)
শবে বরাত বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস পর্ব-৩
৩. মধ্য-শাবানের রাত্রিতে দোয়া-মুনাজাত
মধ্য শাবানের রজনীর ফযীলত বিষয়ে বর্ণিত তৃতীয় প্রকারের হাদীসগুলোতে এ রাত্রিতে সাধারণভাবে দোয়া করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ রাতে দোয়া করা, আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আকুতি জানানো এবং জীবিত ও মৃতদের পাপরাশি ক্ষমালাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ অর্থে কোনো সহীহ বা গ্রহণযোগ্য হাদীস নেই। এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলোর মধ্যে কিছু হাদীস দুর্বল এবং কিছু হাদীস জাল।
৪. অনির্ধারিত সালাত ও দোয়া
মধ্য শাবানের রাত্রি সম্পর্কে বর্ণিত কিছু হাদীসে এ রাত্রিতে সালাত আদায় ও দোয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল হাদীস এ রাত্রির সালাতের জন্য কোনো নির্ধারিত রাক‘আত, নির্ধারিত সূরা বা নির্ধারিত পদ্ধতি উল্লেখ করা হয় নি। শুধু সাধারণভাবে এ রাত্রিতে তাহাজ্জুদ আদায় ও দোয়া করার বিষয়টি এ সকল হাদীস থেকে জানা যায়। এ অর্থে বর্ণিত হাদীসগুলো প্রায় সবই বানোয়াট। দু-একটি হাদীস দুর্বল হলেও বানোয়াট নয়।
৫. নির্ধারিত রাক‘আত, সূরা ও পদ্ধতিতে সালাত
শবে বরাত বিষয়ক অন্য কিছু হাদীসে এ রাত্রিতে বিশেষ পদ্ধতিতে, বিশেষ সুরা পাঠের মাধ্যমে, নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক রাকআত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত মত অনুযায়ী এই অর্থে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট। হিজরী চতুর্থ শতকের পরে রাসুলুলাহ (ﷺ) -এর নামে বানিয়ে এগুলো প্রচার করা হয়েছে। এখানে এ জাতীয় কয়েকটি জাল ও বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করছি।
৬. ৩০০ রাক‘আত, প্রতি রাক‘আতে ৩০ বার সূরা ইখলাস
‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে প্রত্যেক রাকআতে ৩০বার সুরা ইখলাস পাঠের মাধ্যমে ৩০০ রাকআত সালাত আদায় করবে জাহান্নামের আগুন অবধারিত এমন ১০ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’’ হাদীসটি ইবনুল ক্বাইয়িম বাতিল বা ভিত্তিহীন হাদীস সমূহের মধ্যে উল্লেখ করেছেন।( ইবনুল কাইয়িম, নাক্বদুল মানকুল ১/৮৫।)
শবে বরাত বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস পর্ব-৪
৭. ১০০ রাক‘আত, প্রতি রাক‘আতে ১০ বার সুরা ইখলাস
মধ্য শাবানের রজনীতে এ পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন হিজরী চতুর্থ শতকের পরে মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, ৪৪৮ হি. সনে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথম এ রাত্রিতে এ পদ্ধতিতে সালাত আদায়ের প্রচলন শুরু হয়।( মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৩/৩৮৮।)এ সময়ে বিভিন্ন মিথ্যাবাদী গল্পকার ওয়ায়িয এ অর্থে কিছু হাদীস বানিয়ে বলেন। এ অর্থে ৪টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যার প্রত্যেকটিই বানোয়াট ও ভিওিহীন।
এর প্রথমটি আলী (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে প্রচারিত: যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকআতে সুরা ফাতিহা ও ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে সে উক্ত রাতে যত প্রয়োজনের কথা বলবে আল্লাহ তায়ালা তার সকল প্রয়োজন পূরণ করবেন। লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগা লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরির্বতন করে সৌভাগ্যবান হিসেবে তার নিয়তি নির্ধারণ করা হবে, আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ৭০ হাজার ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা তার পাপরাশি মুছে দেবে, বছরের শেষ পর্যন্ত তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন রাখবে, এছাড়াও আল্লাহ তায়ালা ‘আদন’ জান্নাতে ৭০ হাজার বা ৭ লাখ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন যারা জান্নাতের মধ্যে তার জন্য শহর ও প্রাসাদ নির্মাণ করবে এবং তার জন্য বৃক্ষরাজি রোপন করবে...। যে ব্যক্তি এ নামায আদায় করবে এবং পরকালের শান্তি কামনা করবে মহান আল্লাহ তার জন্য তার অংশ প্রদান করবেন।
হাদীসটি স
র্বসম্মতভাবে বানোয়াট ও জাল। এর বর্ণনাকারীগণ কেউ অজ্ঞাত পরিচয় এবং কেউ মিথ্যাবাদী জালিয়াত হিসেবে পরিচিত।( ইবনুল জাওযী, আল-মাওদু‘আত ২/৪৯-৫০; সুয়ুতী, আল-লাআলী, ২/৫৭-৫৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ, ২/৯২-৯৩; মোল্লা ক্বারী, আল-আসরার, পৃ- ৩৩০-৩৩১; আল মাসনু’, পৃ- ২০৮-২০৯; শাওকানী, আল ফাওয়ায়েদ ১/৭৫-৭৬।)
এ বিষয়ক দ্বিতীয় জাল হাদীসটিতে জালিয়াতগণ ইবনু উমার (রা)-এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলেছে: ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে এক শত রাকআত সালাতে এক হাজার বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহ তা‘য়ালা তার কাছে ১০০ জন ফিরিশতা প্রেরণ করবেন, তন্মধ্যে ত্রিশজন তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে, ত্রিশজন তাকে জাহান্নমের আগুন থেকে নিরাপত্তার সুসংবাদ প্রদান করবে, ত্রিশজন তাকে ভুলের মধ্যে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে এবং দশজন তার শত্রুদের ষড়যন্ত্রের জবাব দেবে।’’
এ হাদীসটিও বানোয়াট। সনদের অধিকাংশ রাবী অজ্ঞাতপরিচয়। বাকীরা মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত।( ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত, ২/৫০-৫১; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৫/২৭১; সুয়ূতী, আল লাআলী, ২/৫৯; ফাকিহানী, মুহাম্মদ বিন ইসহাক্ব, আখবারু মাক্কাহ ৩/৮৬-৮৭)
এ বিষয়ক তৃতীয় জাল হাদীসটিতে মিথ্যাবাদীগণ বিশিষ্ট তাবিয়ী ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ আল বাকির (১১৫ হি) থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বরাতে বর্ণনা করেছে: ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ১০০ রাকআত সালাতে ১০০০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করবে তার মৃত্যুর পূর্বেই মহান আল্লাহ তার কাছে ১০০ ফিরিশতা প্রেরণ করবেন। ৩০ জন তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিবে, ৩০ জন তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিবে, ৩০ জন তার ভুল সংশোধন করবে এবং ১০ জন তার শত্রুদের নাম লিপিবদ্ধ করবে।’’
এ হাদীসটিও বানোয়াট। সনদের কিছু রাবী অজ্ঞাতপরিচয় এবং কিছু রাবী মিথ্যাবাদী হিসাবে সুপরিচিত।( ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ ‘আত, ২/৫১; সুয়ূতী, আল-লাআলী, ২/৫৯।)
১০০ রাকআত সংক্রান্ত এ বিশেষ পদ্ধতিটি হিজরী চতুর্থ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন গল্পকার ওয়ায়িযদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং যুগে যুগে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে ভারতীয় ওয়ায়িযগণ এ সালাতের পদ্ধতির মধ্যে প্রত্যেক দু রাকআতের পরে ‘‘তাসবীহুত তারাবীহ’’র প্রচলন করেন এবং ১০০ রাকআত পূর্ণ হওয়ার পর কতিপয় সাজদা, সাজদার ভিতরে ও বাহিরে কতিপয় দোয়া সংযুক্ত করেছেন।
আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৬ হি) বানোয়াট ও ভিত্তিহীন হাদীস সমুহের মধ্যে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। যার সারমর্ম হলো, মধ্য শাবানের রাতে পঞ্চাশ সালামে ১০০ রাকআত সালাত আদায় করতে হবে। প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতিহার পর ১০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। প্রত্যেক দুই রাকআত পর ‘তাসবীহুত তারাবীহ’ পাঠ করবে, এর পর সাজদা করবে। সাজদার মধ্যে কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে। অতঃপর সাজদা থেকে মাথা তুলবে এবং নবী (ﷺ) এর উপর দুরূদ পাঠ করবে ও কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে। অতঃপর দ্বিতীয় সাজদা করবে এবং তাতে কিছু নির্ধারিত বানোয়াট দোয়া পাঠ করবে।( আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার আল-মারফুআ, পৃ- ১১৩-১১৪।)
শবে বরাত বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস পর্ব-৫
৮. ৫০ রাক‘আত
ইমাম যাহাবী এ হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট হাদীস হিসেবে হাদীসটির বর্ণনাকারী অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মাদ বিন সাঈদ আলমীলী আত তাবারীর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। উক্ত মুহাম্মাদ বিন সাঈদ এ হাদীসটি তার মতই অজ্ঞাত রাবী মুহাম্মদ বিন আমর আল বাজালী এর সনদে আনাস (রা) থেকে মারফু হিসেবে বর্ণনা করেনঃ যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের রাতে ৫০ রাকআত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার কাছে যত প্রকার প্রয়োজনের কথা বলবে তার সবটুকুই পূরণ করে দেয়া হবে। এমনকি লাওহে মাহফুযে তাকে দুর্ভাগ্যবান হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হলেও তা পরিবর্তন করে তাকে সৌভাগ্যবান করা হবে। এবং আল্লাহ তা‘আলা তার কাছে ৭ লাখ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার নেকী লিপিবদ্ধ করবে, অপর ৭ লাখ ফেরেশতা প্রেরণ করবেন যারা তার জন্য বেহেশতে প্রাসাদ নির্মাণ করবে ..... এবং ৭০ হাজার একত্ববাদীর জন্য তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে...। ইমাম যাহাবী এ মিথ্যা হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, যে ব্যাক্তি এ হাদীসটি বানোয়াট করেছে আল্লাহ তা‘আলা তাকে লাঞ্চিত করুন।( যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল, ৬/১৬৮-১৬৯।)
৯. ১৪ রাক‘আত
ইমাম বায়হাকী তাঁর সনদে আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ ﷺ-কে মধ্য শাবানের রাতে ১৪ রাকআত সালাত আদায় করতে দেখেছি। সালাত শেষে বসে তিনি ১৪ বার সূরা ফাতিহা, ১৪ বার সূরা ইখলাস, ১৪ বার সূরা ফালাক, ১৪ বার সূরা নাস, ১ বার আয়াতুল কুরসী এবং সূরা তাওবার শেষ দু আয়াত তিলাওয়াত করেন, এ সব কাজের সমাপ্তির পর আমি তাঁকে এগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন: তুমি আমাকে যে ভাবে করতে দেখেছ এভাবে যে করবে তার আমলনামায় ২০টি কবুল হজ্জের সাওয়াব লেখা হবে এবং ২০ বছরের কবুল সিয়ামের সাওয়াব লিখা হবে। পরদিন যদি সে সিয়াম পালন করে তবে দু বছরের সিয়ামের সাওয়াব তার আমলনামায় লেখা হবে।
হাদীসটি উল্লেখ করার পর ইমাম বায়হাকী বলেন: ইমাম আহমাদ বলেছেন যে, এ হাদীসটি আপত্তিকর, পরিত্যক্ত, জাল ও বানোয়াট বলে প্রতীয়মান। হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারীগণ রয়েছে।(বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, ৩/৩৮৬ - ৩৮৭, হাদীস নং - ৩৮৪১।)
অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করার বিষয়ে ইমাম বাইহাকীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। আল্লামা ইবনুল জাওযী ও ইমাম সুয়ুতী বলেন: হাদীসটি বানোয়াট, এর সনদ অন্ধকারাচ্ছন্ন। .... সনদের মধ্যে মুহাম্মাদ বিন মুহাজির রয়েছেন। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল বলেন: মুহাম্মদ বিন মুহাজির হাদীস বানোয়াট-কারী।(ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত, ২/৫২; সুয়ূতী, আল-লাআলী, ২/৫৯-৬০।)
শবে বরাত বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস পর্ব-৬
১০. ১২ রাক‘আত, প্রত্যেক রাক‘আতে ৩০ বার সূরা ইখলাস
জালিয়াতগণ আবু হুরাইরা (রা) পর্যন্ত একটি জাল সনদ তৈরী করে তাঁর সূত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেছে: ‘‘যে ব্যক্তি মধ্য শা’বানের রাতে ১২ রাকআত সালাত আদায় করবে, প্রত্যেক রাকাতে ৩০ বার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, সালাত শেষ হওয়ার পূর্বেই বেহেশতের মধ্যে তার অবস্থান সে অবলোকন করবে এবং তার পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে জাহান্নাম নির্ধারিত হয়েছে এমন দশ ব্যক্তির ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’’
এ হাদীসের সনদের অধিকাংশ বর্ণনাকারীই অজ্ঞাত। এছাড়াও সনদের মধ্যে কতিপয় দুর্বল ও পরিত্যাজ্য বর্ণনাকারী রয়েছে।(ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূআত, ২/৫২; সুয়ূতী, আল-লাআলী, ২/৫৯।)
উপরের আলোচনার মাধ্যমে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, মধ্য শা’বানের রাতে নির্দ্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্দ্দিষ্ট সূরার মাধ্যমে নির্দ্দিষ্ট রাকআত সালাত আদায় সংক্রান্ত হাদীস সমূহ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। মুহাদ্দিসগণ এ ব্যাপারে সকলেই একমত। কিন্তু কতিপয় নেককার ও সরলপ্রাণ ফকীহ ও মুফাস্সির তাঁদের রচনাবলিতে এগুলোর জালিয়াতি ও অসারতা উল্লেখ ছাড়াই এসকল ভিত্তিহীন হাদীস স্থান দিয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ এগুলোর উপর ভিত্তি করে ফতোয়া প্রদান করেছেন ও তদনুযায়ী আমল করেছেন, যা পরবর্তীতে এ রীতি প্রসারিত হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।
মোল্লা আলী ক্বারী (১০১৪ হি) মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায়ের ফযীলত সংক্রান্ত হাদীসগুলোর অসারতা উল্লেখপূর্বক বলেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে, যারা সুন্নাতের ইলমের সন্ধান পেয়েছেন তারা এগুলো দ্বারা প্রতারিত হন কি করে! এ সালাত চতুর্থ হিজরী শতকের পর ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে যার উৎপত্তি হয়েছে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে। এব্যাপারে অসংখ্য জাল হাদীস তৈরী করা হয়েছে যার একটিও সঠিক বা নির্ভরযোগ্য নয়। (মোল্লা ‘আলী ক্বারী, আল-আসরার, পৃ- ৩৩০-৩৩১; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার আল-মুনীফ, পৃ- ৮৯-৯৯।) তিনি আরো বলেন, হে পাঠক, এ সকল ভিত্তিহীন মিথ্যা হাদীস ‘কুতুল কুলুব’, ‘এহয়িয়াউ উলুমিদ্দীন’ ও ইমাম সা‘লাবীর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ থাকার কারণে আপনারা প্রতারিত ও বিভ্রান্ত হবেন না। (মোল্লা আলী ক্বারী, আল মাসনূ’, পৃষ্ঠা- ২০৮-২০৯।) ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ আজলুনীও (১১৬২ হি) অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। (আজলুনী, কাশফুল খাফা, ২/৫৫৪-৫৫৫।)
আল্লামা শাওকানী (১২৫০ হি) শবে বরাতের রাত্রিতে আদায়কৃত এ সালাত সংক্রান্ত হাদীসের ভিত্তিহীনতা উল্লেখ পূর্বক বলেন, এ সকল হাদীস দ্বারা এক দল ফকীহ প্রতারিত হয়েছেন। যেমন ‘এহয়িয়াউ উলূমিদ্দীন’ গ্রন্থকার ইমাম গাযালী ও অন্যান্যরা। এমনিভাবে কতিপয় মুফাস্সিরও প্রতারিত হয়েছেন। এ সালাতের বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের জাল হাদীস রচিত হয়েছে। এ সকল হাদীস মাউযূ বা বানোয়াট হওয়ার অর্থ হলো, এই রাত্রিতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত রাক‘আত সালাত আদায়ের প্রচলন বাতিল ও ভিত্তিহীন। তবে কোনো নির্ধারিত রাক‘আত, সূরা বা পদ্ধতি ব্যতিরেকে সাধারণ ভাবে এ রাত্রিতে ইবাদত বা দোয়া করার বিষয়ে দুই একটি যয়ীফ হাদীস রয়েছে।’’
(শাওকানী, আল-ফাওয়ায়িদ ১/৭৬।)
শবে বরাতের ইতিহাস (history of shab e barat)
হযরত মুহাম্মদ (সা.) হতে শবে বরাতের ব্যাপারে অনেক হাদীস আমাদের হস্তগত হয়েছে। তবে যেসব হাদীসসমূহ পরিপূর্ণতার আলোকে ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যতারাখে তা নিম্নে বর্ণিত হল, যথা:
রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন: শা’বান মাসের মধ্য রজনীতে (১৫ ই শা’বানের রাতে) ঘুমিয়ে ছিলাম এমন সময় জিব্রাঈল(আ.)আমার শিয়রে উপস্থিত হয়ে বলল: হে মুহাম্মদ উঠুন! এরপর সে আমাকে শোয়া থেকে উঠালো এবং বাকী কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে বলল: আকাশের দিকে চেয়ে দেখুন! আজ রাতে আসমানের দরজাসমূহ, রহমতের দরজাসমূহ খুলে যাবে এবং খুলে যাবে সকল সুখ, সমৃদ্ধি, ক্ষমা, রুযি, পরিত্রাণ পাওয়া ও পূনর্জ্জিবীত হওয়ার দরজাসমূহ ও আরো অন্যান্য ...।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা এ রাতে চতুস্পদ জন্তুর গায়ের চুল ও পশমের পরিমাণ নিজ বান্দাগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করবেন। এ রাতে তিনি মৃত্যুর সময় এবং আগামী এক বছরের রিযিক (এখানে সকল নেয়ামতকেই বুঝানো হয়েছে) নির্ধারণ করবেন। হে মুহাম্মদ! যারা এ রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালাকে পবিত্র ও একক সত্তা যেনে তাঁর যিকির করবে, তাকে রাজি-খুশি করার জন্য নামায-দোয়া পড়বে, পবিত্র কোরআন পাঠ করবে ও অধিক পরিমাণে এস্তগফার করে রাতকে প্রভাবে পৌছাবে তাদের স্থান হবে বেহেশ এবং তারা ইতিপূর্বে যা কিছু (গোনাহ) আঞ্জাম দিয়েছে ও পরবর্তিতে আঞ্জাম দিবে তাও ক্ষমা করে দিবেন...।
দ্বিতীয় হিজরীর ১৫ইশা’বানের মধ্য রাতে উক্ত ঘটনাটি সংঘটিত হয়। আর তখন থেকেই শবে বরাতের এ রসম-রেওয়াজ প্রচলিত হয়। (ইবনে তাউউস, আলী বিনমুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.- ২১২, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল আয়া’লামিলিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী। আল্ মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকির, বিহরুল আনওয়ার, খণ্ড-৯৮,পৃ.-৪১৩, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল ওয়াফা, ১৪০৩ হিজ)
আমরা এটা জানি যে, এ পৃথিবীতে কোন কিছুই কার্যকারণ ব্যতীত সংঘটিত হয় না। তাই ১৫ই শা’বান ফযিলত মণ্ডিত হওয়ার পেছনেও নিহিত রয়েছে উপযুক্ত কার্যকারণ। আর তা হচ্ছে আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়াতা’য়ালার সর্বশেষ হুজ্জাত, নবী(সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বংশধারার নবম সন্তান ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর শুভ জন্মরাত।
যিনি শেষ যমানায় আবির্ভূত হয়ে বিশ্বকে সমস্ত প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, নীপিড়ন-নির্যাতন ও যালিমের যুলুম থেকে রক্ষা করে ন্যায়ের মানদন্ডের আওতায় নিয়ে আসবেন এবং খোদায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। তখন এ পৃথিবীতে থাকবে না কোন প্রকার যুলুম-অত্যাচার, থাকবে না কোন ভেদাভেদ, বাঘ ও ছাগল একই তীরে এক সঙ্গে পানি পান করবে। তখন না বাঘ ছাগলের উপর হামলা করবে আর না ছাগল বাঘকে ভয় পাবে। আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন আমাদেরকে সে দিন দেখে যাওয়ার তৌফিক দান করুন।
এ রাত ফযিলত মণ্ডিত হবার প্রকৃত কারণ আমারা জানতে পারলাম। পবিত্র মা’সুমিন(আ.)-গণও এ রাত ফযিলত মণ্ডিত হবার প্রকৃত কারণ এই পবিত্র ব্যক্তিত্বের জন্ম গ্রহণের কারণকেই উল্লেখ করেছেন। সাইয়্যেদ বিন তাউস তিনি স্বীয় গ্রন্থে লিখেছেন: যেহেতু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা এত বড় ও সর্বাধিক উত্তম কল্যান বা অনুগ্রহ দান করেছেন সেহেতু প্রতিটি মানুষের উচিৎ সেই মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা এবং শরীরের সর্বশেষ শক্তি দিয়ে এই সর্বোত্তম এলাহী নেয়া’মতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। (ইবনে তাউউস, আলীবিন মুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.-২০৭ থেকে ২৩৭ পর্যন্ত, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক:মুয়াস্সিসাতুল আয়া’লামি লিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী। আল্ মাজলিসি, মুহাম্মদ বাকির, বিহরুল আনওয়ার, খণ্ড-৯৪, পৃ.-৮৫, হা.-৫, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুলওয়াফা, ১৪০৩ হিজরী।)
আমরা ১৫ই শা’বানের আমলে লিপিবদ্ধ একটি দোয়ায় পড়ে থাকি যে,
((اللهم بحق ليلتنا هذه و مولودها و حجتك و موعودها التى قرنت الى فضلها فضلا فتمت كلمتك صدقا و عدلا لا مبدل لكلماتك ...))
হে আল্লাহ্! তোমাকে এ রাতের ও এ রাতে জন্মগ্রহণকারীর উছিলা দিয়ে ডাকছি এবং তোমার সত্য ও প্রতিশ্রুত হুজ্জাতের উছিলা ধরছি যে, যার কারণে ফযিলতের উপর ফযিলত দিয়েছো। আর তোমার সত্য ও ন্যায়ের বাণী পরিপূর্ণতায় পৌচেছে এবং তোমার বাণীর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার ক্ষমতা করো নেই। (ইবনে তাউউস, আলীবিন মুসা, ইকবালুল আ’মাল, পৃ.-২১৯, বৈরুত প্রিন্ট, প্রকাশক: মুয়াস্সিসাতুল আয়া’লামিলিল মাতবুআ’ত, ১৪১৭ হিজরী।)
ইমাম মাহদী (আ.ফা.)যে ২৫৫ হিজরীর ১৫ই শা’বানে জন্মগ্রহণ করেছেন তার প্রমাণ শিয়া ও সুন্নি মাযহাবের অনেক রেওয়ায়েতেই পাওয়া যায় এবং উক্ত হাদীসসমূহে এ বিষয়টিও পরিস্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, এ রাতে তাঁর জন্মগ্রহণই হচ্ছে এ রাতের ফযিলতের কারণ। (আল্ কুলাইনী, মুহাম্মদ বিন ইয়াকুব, আল্ কাফী, খণ্ড-১, পৃ.-৫১৪, তেহরান প্রিন্ট, প্রকাশক: দারুলকুতুবিল ইসলামিইয়্যা, সন ১৩৬৫ ফার্সি। আছ্ ছাদুক, মুহাম্মদ বিন আলী ইবনুল হুসাইন, কামালু্দ্দিন ওয়া তামামুন্ নেয়া’মাত, খণ্ড-২, পৃ.-৪৩২, তেহরান প্রিন্ট, প্রকাশক:দারুল কুতুবিল ইসলামিইয়্যা, সন ১৩৯৫ ফার্সি। সাবরাবি, আব্দুল্লাহ্ বিন মুহাম্মদ, আল্ ইত্তাহাফু বিহুব্বিল আশরাফ, পৃ.-১৭৯। ইবনে ছাব্বাগুল মালিকি, নুরুদ্দিন আলী বিনমুহাম্মদ, আল্ ফুছুলুল মুহিম্মাতু ফি মায়া’রিফাতিল আইম্মাহ্, পৃ.-৩১০।)
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতা’য়ালা এ রাতকে উপলব্দি করার তৌফিক আমাদের সকলকে দান করুন।
শবে বরাতের দোয়া (Duas to Recite on Shab e Barat)
মাহমূদ আলূসী নিজ তাফসীরগ্রন্থে ইবনে আবি শায়বা কৃত ‘মোসান্নাফ’ পুস্তক হতে হযরত ইবনে মাসউদ (রা:)-এর কথা উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন,
বান্দা আল্লাহর কাছে (নিচের) এই দোয়া করলে তিনি তার জীবন-জীবিকা বৃদ্ধি করে দেন: হে আল্লাহ! অফুরন্ত রহমত-বরকতের অধিকারী! হে সর্বোচ্চ শান-শওকত, সম্মান ও ক্ষমতার মালিক! আপনি ভিন্ন অন্য কোনো খোদা নেই। আপনি-ই আশ্রয়হীনদের আশ্রয় এবং নৈকট্য অন্বেষীদের প্রতিবেশী (নিকটবর্তী); মুত্তাকী (খোদাভীরু)-দের অভিভাবক। এয়া আল্লাহ! আপনি যদি আপনার মূল লিপিতে আমার দুর্দশা ভারাক্রান্ত হবার বিষয়টি নির্ধারণ করে থাকেন, তবে তা অপসারণ করুন এবং আমাকে সুখ-সমৃদ্ধি দান করুন। হে আমার প্রভু! আপনি যদি আপনার কেতাবে আমার জন্যে আপনার রহমত (আশীর্বাদ) বাদ দেয়ার কথা লিখে রাখেন, তবে তা মুছে দিন এবং আমার রিযক আমার জন্যে সহজ করে দিন; আপনার দরবারে আমাকে সুখী, সৎকর্মশীল ও সমৃদ্ধিশালী করে দিন। কেননা, আপনি আপনার পাক কালামে এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ যা চান নিশ্চিহ্ন করেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেন; এবং মূল লিপি তাঁরই কাছে রয়েছে’।
— আল-কুরআন, ১৩:৩৯, মুফতী আহমদ এয়ার খান সাহেব কৃত ’নূরুল এরফান’
আবদ ইবনে হুমাইদ এবং অন্যান্যরা বর্ণনা করেন যে হযরত উমর ফারুক (রা:) কাবা শরীফের তাওয়াফকালে দোয়া করেন:
এয়া আল্লাহ! যদি আপনি লিখে রাখেন আমি দুঃখী বা পাপী হবো, তবে তা (পরিণতি) মুছে দিন এবং আমার ভাগ্যে সুখ-সমৃদ্ধি ও গুনাহ মাফের বিষয়টি লিখুন। কেননা, আপনি যা চান নিশ্চিহ্ন করেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেন, আর আপনার কাছেই রয়েছে মূল লিপি।
হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রা:) ও হযরত মোজাহিদ (রা:)-এর তরীকা (পদ্ধতি) অনুসারে ইবনে জারির তাবারীর বর্ণনায় এবং অন্যান্য রওয়ায়াত ও আল-এয়াফী’ হতে ‘আল-এবদা’আ’ পুস্তকের লেখকের বিবরণে জানা যায়, শবে বরাতে প্রথমে যে দোয়া করা হয় তা হলো -
এয়া আল্লাহ, অফুরন্ত রহমত-বরকতের মালিক!
0 Comments